ঝন্টু- শিশির আহাম্মেদ খান

                                                                        ঝন্টু
       

                       

ঝন্টু ও মন্টু দুই ভাই। ঝন্টুর বয়স দশ বছর। সে কাদিপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে। মন্টুর বয়স পাঁচ বছর। সে এখনো স্কুলে যায় না। মন্টুর সারাক্ষণ শুধু খেলা-ধুলা আর দুষ্টুমি করেই কেটে যায় বেলা। দুই ভাইয়ের মধ্যে খুব ভাব ! তাই ঝন্টু মাঝে মধ্যে মন্টুরে স্কুলে নিয়ে যেত। ঝন্টু মাঝে মাঝে আইসক্রীম কিনে মন্টুকে নিয়ে একসাতে খাওয়া, বিকেলে মন্টুকে সাথে নিয়ে মাঠে খেলতে যাওয়া কখনো তার ভুল
হত না।
ঝন্টু ছোট ভাই মন্টুর প্রতি যতই øেহ পরায়ণ হোক না কেন? অন্যের প্রতি ছিল খুব দুষ্টু আর বদমেজাজী। সে বড়দের মুখে মুখে কথা কাটাকাটি করত। এ গাঁয়ের এমন কোন পুলাপাইন নাই যে ঝন্টুর হাতে মাইর না খাইছে। তার কাজে বাঁধা দেবার কেউ ছিলনা। তাই সব ছেলেমেয়ে ঝন্টুরে খুব ভয় পাইতো। ঝন্টুর যখন যা ইচ্ছা হত, তাই করে বস্ত।
কাদিপুর গাঁয়ের সব লোক তারে ভয় করত। কেউ যদি কিছু বলত, তবে তার রক্ষা ছিল না। এমন এক ভ্যাংচি দিত যে ভয় পেয়ে যেত, না হয় খামছি মেরে দৌড়ে পালাত। আর যদি কেউ তার নামে কোন নালিশ দিয়ে যেত, তার মায়ের কাছে ! তবে তার ঐ দিন কোন না কোন ক্ষতি হয়ে যেত। তার এমন কাজ ছিল না, যা অসাধ্য। জালি দিয়ে মাছ ধরা, বরশি দিয়ে মাছ ধরা, বিলের পানিতে অথৈ জলে নেমে ডুব সাঁতার কাটা, এ সবই ছিল রপ্ত করা বিষয়। এমন কি ডুব দিয়ে মাছ ধরাও ছিল তার এক আঙ্গুলের ব্যাপার। মন্টু তীরে বসে বায়না ধরত শাপলা ফুল এনে দেওয়ার। ঝন্টু লাল শাপলা, সাদা শাপলা এনে মালা বানিয়ে মন্টুরে দিত, মন্টু খুব খুশি হত। ছোট ভাই মন্টুকে সে খুব ভালবাসত। তার যত খেলার জিনিস ছিল সব মন্টুই নিয়ে যেত আর সে গুলো দিয়ে খেলা করত। এতে কখনো দুই ভাই ঝগড়া করত না।
পাড়ার সব বাচ্চারা ভয় করলেও, তারা মন্টুকে খুব ভালবাসত। তাই খেলা-ধুলা, দুরন্তপনা যাই করুক না ঝন্টুরে নিয়ে করত।
গোল্লা, বৌছি, দাড়িয়া বান্দা, চোর-পুলিশ খেলা, পানিতে নেমে সুই-সুঁতা খেলা, চিকুত চিকুত খেলা ইত্যাদি খেলা গুলো খুব পারদর্শি ছিল সে। তাছাড়া লুডু, পাইত, চার কটি খেলায় ছিল সে খুব উস্তাদ। তাছাড়াও সে মারবেল খেলায় খুব দক্ষ। তার আর একটা নেশা ছিল পাখির বাসা ভেঙ্গে দেওয়া, পাখির ডিম ভেঙ্গে দেওয়া, পাখির বাচ্চা ধরে বাড়ী এনে খাচায় বন্দী করে রাখা। কাঠবিড়ালী ধরে লেজ সেলাই করে ছেড়ে দেওয়া। বিড়ালের লেজ কেটে দেওয়া, মাঠ থেকে ছাগলের বাচ্চা কোলে করে বাড়ী নিয়ে আসা, পিপড়ার বাসায় খুচা মারা, কি আবার মৌচাকে ঢিল ছুড়ে মারা ইত্যাদি ছিল তার দৈনিক কাজের তালিকা।
রিক্সার চাকার টায়ার নিয়ে গাড়ি গাড়ি দৌড় খেলা ছিল ঝন্টুর খুব পছন্দ। সে বাঁশের ডগার কঞ্চি দিয়ে কামান তৈরী করে দাতই বিচি তার মধ্যে ভরে ফুটানো। গুলাই দিয়ে পাখি শিকার করা। সারা দিন শুধু শুধু টু---টু----টু করে রৌদ্রে ঘুরে বেড়ানো ইত্যাদি ছিল তার দৈনিক কাজের তালিক।
স্কুলে গিয়ে স্যারের বেত চুরি করা। সহপাঠির হাতের লেখার খাতা লুকিয়ে স্যারের বকা শুনানো হর হামেশাই করত। প্রতি দিন ঝন্টুর নামে স্যারদের কাছে অসংখ্য নালিশ যেত। স্যারও বিরক্ত হয়ে যেইনা বেত হাতে তেড়ের আসত অমনি সে দে ছু----ট। এত কিছুর পরও স্যার, ম্যাডাম ঝন্টুরে খুব আদর করত। কারণ সে এত দুষ্টুমি করেও লেখাপড়ায় খুব ভাল। প্রতিবারই প্রথম স্থানে উত্তীর্ণ হয়। তাই অনেক সময় মজিদ স্যার বলে, ঝন্টু তুমি যদি দুষ্টুমি বাদ দিয়ে মনোযোগ সহ পড়ালেখা কর, তবে একদিন অনেক বড় মানুষ হবে।
ঝন্টু        ঃ স্যার ! ও স্যার।
মজিদ স্যার    ঃ কি?
ঝন্টু        ঃ কত বড় স্যার?
মজিদ স্যার    ঃ অনেক অনেক বড়।
ঝন্টু        ঃ কত বড়, আমি কি পাগলা স্যারের সমান হইতে পারমু?
মজিদ স্যার    ঃ পাগলা স্যার কি? শিক্ষক হইল মুরব্বী মানুষ, তারে কি কেউ পাগলা ডাহে।
ঝন্টু        ঃ “হ স্যার, সব ছাত্ররাই ডাহে”।
মজিদ স্যার    ঃ চুপ কর। দুই দিনের পুলা না পান্না-পান্না কথা।
ঝন্টু        ঃ স্যার আমার বয়স দুই দিন না। আমার বয়স দশ বছর।
মজিদ স্যার রেগে গেলেন এবং টেবিলের উপর খুব জোরে বেতের বাড়ি দিয়ে চুপ করতে বললেন।
সবাই চুপ হয়ে গেল। কিন্তু ঝন্টু হইল না। সে আবার বলল স্যার আমি বড় হইয়া যদি পাগলা স্যারের সমান হই---
মজিদ স্যার    ঃ আবার পাগলা ----
ঝন্টু        ঃ না স্যার, পাগলা না আধ পাগলা অংক স্যারের কান ঢলে দিমু।
ঝন্টুর আধ পাগলা কথা শুনে ক্লাসের সবাই হুহু করে হেসে ফেলল। মজিদ স্যারও হেসে দিলেন। কিন্তু কাউকে কিছু বুঝতে দিলেন না। তিনি চুপটি করে ক্লাশ থেকে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আবার আসলেন ক্লাশে মজিদ স্যার। এসেই ঝন্টুর কাছে গেলেন এবং তাকে জিজ্ঞাসা করলেন। আচ্ছা ঝন্টু তুমি অংক স্যারে-রে পাগলা স্যার বল কেন?
ঝন্টু        ঃ স্যার হেয় আমার অংক হওয়ার পরেও কান ধরে ওঠ-বস করাইছে। আরও কইছে যদি হের কথা         না শুনি তবে আমার পিঠের চামড়া তুলইয়া ফেলব বেতায়ে।

মজিদ স্যার কয়েকটা উপদেশ বাণি শুনিয়ে এবং একটা কবিতা শুনাইলেন ও পড়া দিলেন।
কবিতাটি এমন-
        আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে,
        কথায় না বড় হয়ে, কাজে বড় হবে।
ঢ়ং ঢ়ং করে ছুটির ঘন্টা বেজে গেল।
স্কুল ছুটি শেষে বাড়ি ফিরার পথে ঝন্টু তার বন্ধুদের নিয়ে ইতিদের শশা গাছ থেকে শশা ছিড়ে খাইতে খাইতে বাড়ি ফিরল। ইতি তার সাথে পড়ত, ইতিকেও ঝন্টু একটা শশা দিল।
ইতি যখন শশা খেতে খেতে বাড়ি গেল; অমনি তার মা জিজ্ঞাস করল শশা কোত্থেকে আনলি?
ইতি        ঃ ঝন্টু দিছে আমাগ গাছতে পাইরা।
    ইতির মা রেগে-মেগে নালিশ নিয়ে ঝন্টুর মার কাছে গেল এবং ঝন্টুর মার কাছে বলল; ভাবী আজকা ঝন্টু আমাগ গাছতে শশা চুরি করেছে।
ঝন্টু সবে কাপড় খুলে হাত-মুখ ধুয়ে খেতে বসেছে। ইতির মার কথা শুনে ঝন্টুর মা ঝাড়– নিয়ে তেড়ে গেল ঝন্টুরে মারতে। কিন্তু নাগাল পাওয়ার আগেই দে ছুট। সে পালিয়ে গিয়েই শেষ হলো না। প্রথমে গেল ইতিদের শশা গাছের কাছে এবং সব শশা গাছ টেনে ছিড়ে পালিয়ে গেল।
এদিকে ইতির মার ত মাথায় হাত। হায় দুইটা শশার জন্য বিচার দিয়ে ত আমার পুরো গাছাই শেষ করে দিল।
এক দিনের কথা। ঝন্টু সকাল এগারটায় স্কুল শেষে বাড়ি ফিরছে। সে রাস্তার পাশে আম গাছটার নিচ দিয়ে ফেরার সময় একটা পাখি তার মাথার উপর হাগু করে দিল। মাথায় হাত দিয়ে, যখন সে তার হাতের মধ্যে দেখল, সাদা সাদা কি লেগে আছে। নাকের কাছে নিতেই ওঁ, ওঁ কি না গন্ধরে ভাই। ঝন্টু উপর দিকে তাকাল এবং একটা শালিক পাখি বসে আছে একটা সরু ডালার উপর। ঝন্টু পাখিটির উপর খুব রাগ হল। কাছ থেকেই একটা মাটির ঢেলা নিয়ে ছুড়ে মারল পাখির দিকে। শালিকটিও ছিল বেজায় চালাক, সে ওড়ে গিয়ে বসল গাছের সবচেয়ে উচু ডালায়। ঝন্টু হতাশ হয়ে গাছের উপরে তাকাল আর অমনি শালিকটা ডেকে ওঠল। সাথে সাথে কঁচি কঁচি ডাক শুনা গেল। ঝন্টু একটা ব্যাপার বুঝে গেল। সে একটু ভাল করে গাছের দিকে তাকিয়ে খুঁজে দেখল শালিকটি একটা খড়-কুটার বাসার পাশে বসে আছে। এই দেখে ঝন্টু বই হাতে দৌড়ে বাড়ী আসল এবং মন্টুরে বলল- মন্টু তাড়াতাড়ি চল। মন্টু- কোথায়?
-    একটা শালিক পাখির বাসা দেখছি। তার মধ্যে দুইটা ছাও (বাচ্চা) আছে।
মন্টু        ঃ না,আমি তোমার লগে যাইতাম না। তোমার মাথায় আর শার্ডে (শার্ট) কি বরছে জানি?

ঝন্টু বারান্দায় বই গুলো ছুড়ে দিয়ে তার গায়ের শার্ট খুলে বারান্দায় ফেলে দিল। এক বালতি থেকে লুটা দিয়ে পানি নিয়ে মাথায় ঢেলে তাড়াহুড়া করে লাইফবয় সাবান দিয়ে ধুয়ে ওঠোনে রৌদ্রে শুকাতে দেওয়া তার মার শাড়ির আঁচল দিয়ে মাথা মুছে বলল এহন আয়, তাড়াতাড়ি যাইতে অইব।
মন্টু ভাইয়ের পিছু দৌড় দিল।
ঝন্টু বলল তুই গাচের নিচে খাড়াবি আর আমি ছাও (বাচ্চা) পারমো। মন্টু-ঝন্টুর অনেক পিছনে দৌড়াতে লাগল আর বলতে লাগল ভাইয়া আমারে লইয়া যাও। ঝন্টু একটু থেমে পিছন ফিরে মন্টুরে তাড়া দিল। দৌড়ে দুই ভাই গিয়ে দাড়ানো ঐ গাছটার নিচে। ঝন্টু গাছে ওঠা শুরু করল। মন্টু দাঁড়িয়ে ভাইকে সাহায্য করল। ঝন্টু একেবারে গাছের আগায় ওঠে গেল এবং ঐ শালিকের বাসার কাছে ওঠে দেখল কি সুন্দর দুইটা ছানা। এক হাতে গাছের ডালে ধরে অন্য হাতে পাখির ছানা ধরে চট্ পট্ নেমে পড়ল গাছ থেকে। এদিকে শালিক মা’ টি তার ছানাগুলোকে বাঁচানোর জন্য অনেক চেষ্টা চালিয়ে অবশেষে ব্যর্থ হয়ে করুণ সুরে ডাকতে লাগল।
 (পর্ব: ০১)
                                                                                                                       লেখক : শিশির আহম্মেদ খান

Comments

Popular posts from this blog

অজেয় তারুণ্য / শিশির আহাম্মেদ খান

রক্ত গঙ্গা / শিশির আহাম্মেদ খান

White - Shishir Ahmed Khan