লোভ - শিশির আহাম্মেদ খান
লোভ !
(দস্যি ছেলে বই থেকে)
শিশির আহাম্মেদ খান।
দিদির কাছে শুনা। বহু বছর আগের কথা। মিশর দেশের বেদুইনদের কথা । সেই যুগে ব্যবসা বাণিজ্য ছিল প্রধান পেশা। তারা উটের উপর চড়ে এ শহর থেকে ঐ শহরে সওদা করে বেড়াত।তাদের মাঝে তিন ব্যাক্তি ছিল , একজন লোভী, একজন মিথ্যুক ও আরেক জন ছিল প্রতারক। তারা সব সময় মানুষ কে ঠকাতে চাইত এবং কোন না কোন লোক তাদের কাছে প্রতারিত হত। সাধারণ মানুষ কে খুব সহজে বোকা বানাতে পারত। একবার গ্রামের লোকজন বিরক্ত হয়ে ওদের তিন জন কে গ্রাম ছাড়া করল। তারা গ্রাম ছেড়ে আসার সময় গ্রামবাসীদের বলে আসল আর কোন দিন তিন জন গ্রামে ফিরবে না।বিকেলের সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে, তপ্ত বালির উপর দিয়ে পূর্ব দিকে হাঁটতে লাগল। সাথে সামান্য কিছু খাদ্য ও পানি খাদ্য হিসেবে ছিল । কিন্তু কোন বাহন ছিল না পায়ে হেটে চলছে, কোন তাবু ছিল না সাথে। সন্ধ্যা নেমে এল প্রায় । অনেক টা ঠান্ডা নেমে আসছে । ওরা যখন একটা জায়গাতে বসে হালকা খাবার খেয়ে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য থামল । তখন রাত হয়ে গেছে , হিমেল হাওয়া বইছে সেই সাথে শীত বাড়ছে। চারিদিক ধূ ধূ মরুভূমির মধ্যে একটা ছোট্ট পাহাড়ে বসে বিশ্রাম করছে ওরা।
নিজেদের মধ্যে ওরা ছলা পরামর্শ করে নিচ্ছে নিজেদের মাঝে । রাতের মেঘ মুক্ত আকাশে পূর্ণ চাঁদের ঝলমলে জ্যোৎস্না, মরুর বুকে এ যেন স্বর্গীয় রূপ। হঠাৎ করে অদূরে একটা আলোর ঝলকানি দেখতে পেল একজন। তাড়াতাড়ি বাকিদের দেখাল , একটা তাবু । তিন জনের মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি আটল, তাই তাড়াহুড়া করে তাবুর দিকে হাঁটতে লাগল। তাবুর ঠিক কাছাকাছি যেতেই দেখল, দুই জন লোক ছোট্ট একটা আগুনের কুণ্ডুলীর পাশে বসে আছে। তারা আগুনে পুড়ে কি যেন খাচ্ছে । তিন জন কে ওদের কাছে আসতে দেখে ঐ দুই জন উঠে দাঁড়াল অনেক টা ভীত হয়ে । কিন্তু মুখে কিছুই বলল না।
এ দিকে ওরা তিন জনের একজন বলল, ভাই আমরা খুব বিপদে পড়েছি । যদি আমাদের একটু সাহায্য করতেন ? অন্য জন বলল ভাই আমাদের মহা বিপদ , যদি কারো সাহায্য না পাই । তবে এখানেই মরে পড়ে থাকতে হবে । তৃতীয় জন বলল , আমরা সওদাগর। পথিমধ্যে একদল ডাকাত আমাদের সব কিছুই লুট করে নিয়েছে। আমাদের ঘোড়া গুলি পর্যন্ত ছিনিয়ে নিয়ে গেছে । এখন আমাদের কোন খাবার নেই, এমন কি পানি পর্যন্ত নেই। এই বিশাল মরুভূমির মধ্যে কি করব আমরা বুঝে উঠতে পারছি না।এমনিতেই আমরা পশ্চিম হতে অনেক পথ পারি দিয়েছি ।দুই জন , আগন্তুক তিন জনের কথা বিশ্বাস করে ওদের কে তাঁবুতে বসিয়ে খেতে দিল । তিন জন ত মহা খুঁশি, প্রথম পরীক্ষায় পাশ । ওরা তিন জনে বাকি সব খাবার শেষ করে এক মশক পানি পান করে ফেলল। খাবার শেষ করে জমিয়ে কিছুক্ষণ গল্প করল । গল্পের মধ্যেই জেনে নিল ওরা কোথা থেকে এসেছে আর কোথায় যাবে আর কি তাদের পেশা । লোক দু'জন নেহাত সহজ সরল প্রকৃতির। তাদের সাথে অনেক স্বর্ণ মুদ্রা ছিল। সিরিয়া থেকে বানিজ্য করে দেশে ফিরছিলেন দুই জন। এখানে তাবু গড়েছে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য আর কিছু সময়ের জন্য বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। এখন আবার রওনা দিবে, মরুভূমিতে দিনের বেলা চলাফেরা খুবই কষ্ট কর। বালু অনেক গরম থাকে। দুই জন তিন বন্ধু কে বলল, চলেন আমরা এক সাথেই চলতে থাকি ।
তিন বন্ধু বলল, চলুন তবে যাওয়া যাক। তাই হল , তাবু আবার তুলে ঘোড়ার পিঠে চেপে দিল। দুই পথিক বলল , আপনেরা চলেন আমাদের পিছু পিছু । দুই জন আগে আগে হাটতে শুরু করল, অমনি তিন বন্ধু ওদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। ওদের মেরে নাস্তানাবুদ করে বালিতে ফেলে দিল। লোক দুটো বালির উপর ছটফট করতে লাগল। তিন জন ঐ দুই জনের সমস্ত কিছু লুটে নিল। লোভী আর প্রতারক এক ঘোড়ায় উঠল। মিথ্যুু অন্য ঘোড়ায় ওদের লুটের মালামাল সহ চড়ল।
ঘোড়া দুটোর মালিক দুই জন পড়ে রইল মরুভূমির বুকে।পূর্ব দিকে রাতের রূপালী চাঁদের আলো জলতে লাগল। লোভী বন্ধু বলল, বন্ধু আমরা ঘোড়া পেয়েছি দু'টো আর স্বর্ণের থলি পাইলাম দু' টো । কিন্তু মানুষ তিন জন, এখন কি করে ভাগ করি বলত ? সাথের জন বলল, একটা ঘোড়া আমার আর একটা তোমার, একটা স্বর্ণের থলি আমার অন্য টা তোমার।
লোভী বন্ধু :- এই টা খুব সুন্দর ও ন্যায় সঙ্গত হবে । যদিও এই ভাগ কখনও মিথ্যুক বন্ধু মেনে নিবে না।
প্রতারক বন্ধু :- তাকে আমরা কিছু সামনের দিকে অগ্রসর হয়ে মরে বালিতে পুঁতে রাখব। যেই কথা সেই কাজ, মাঝ রাতে মাথার উপর চাঁদ। একটা জায়গাতে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য দাঁড়াল ওরা।বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিবে তাই বালিতেই বসে পড়ল।
হঠাৎ করেই লোভী বন্ধু আর প্রতারক বন্ধু মিথ্যুক বন্ধু কে বালির মধ্যে মুখ চেপে ধরে রাখল । এভাবে কিছুক্ষণ থাকার পর বন্ধুটি মৃত্যুবরণ করল।মৃত বন্ধুর লাশ টা বালি চাপা দিয়ে সামনের দিকে রওনা হল। এইবার বেশিক্ষণ চলল না , বেশ কিছু পথ গিয়ে একটা জায়গায় থামল এবং তাবু টানল। এখন আর তাড়া নেই, মধুর বিশ্রাম করে শেষ রাতের দিকে যাওয়া যাবে। লোভী বন্ধু বলল, প্রতারক বন্ধু কে রাতের খাবার তৈরি করার জন্য বলল আর সে ঘোড়ার উপর থেকে মালামাল নামিয়ে আনতে গেল। প্রতারক বন্ধু আগুন জ্বালিয়ে রান্না করতে লাগল। এই দিকে লোভী বন্ধু মালামাল নামিয়ে তাঁবুতে রাখছে। এত স্বর্ণ মুদ্রা দেখে লোভী লোকটা আর্তহারা হয়ে গেল। সে মনে মনে ভাবল এত সম্পদ তার অর্ধেক দিয়ে দিতে হবে । না , আমি দিতে রাজি না। আমি একাই নিব এই সব ধন সম্পদ । আমি একাই হব এর মালিক। এই দিকে প্রতারক লোকটা খাবার তৈরির সময় চিন্তা করল , দুই থলে স্বর্ণ মুদ্রার মধ্যে এক থলে এবং দুই ঘোড়ার মধ্যে একটা আমি নিব ? বাকি গুলো ওকে দিয়ে দিতে হবে । কিন্তু এখন যদি সে না থাকে , সব কিছুই আমার হবে। তাই সে একটা সাপ ধরে বিশ মিশিয়ে দিল খাবারের এক পাশে এবং লোভী বন্ধুর কাছে নিয়ে গেল।
এই দিকে লোভী বন্ধু ফন্দি করছে প্রতারক বন্ধুটি কে মারার। খাবার নিয়ে তাঁবুতে ঢুকতেই খঞ্জর বসিয়ে দিল বুকের মধ্যে। প্রতারক বন্ধু কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। লোভী বন্ধু টা মহা খুঁশি , এখন সে সব ধন সম্পদের একাই মালিক। সে তাড়াতাড়ি লাশটা বালি চাপা দিয়ে তাঁবুতে এসে বসে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। মনে মনে ভাবতে লাগল, এই বার সে অনেক ধনী। তার জীবনে আর কখনও দুঃখ্য দুর্দশা থাকবে না । সে একটা রাজকন্যা কে বিয়ে করবে ইত্যাদি ইত্যাদি । অনেক পরিশ্রম করার জন্য সে খুবই ক্ষুধার্ত । তাই তাড়াহুড়ো করে খাবার খেয়ে নিল। খাবার খাওয়ার কিছুক্ষণ পর কেমন যেন ছটফট করতে লাগল। গলাতে কেমন যেন লাগছে , মুখে ফেনা বের হচ্ছে । বালিতে লুটিয়ে পড়ল সে এবং আফসোস করতে লাগল। অশ্রু সিক্ত নয়ন বুজে আসতে লাগল। ঘোড়া আর ধন সম্পদ মরুভূমির বুকে পড়ে রইল আর মরিচিকার মতন লোভী , প্রতারক ও মিথ্যুক বন্ধু তিন জন লোভের কারণে ধ্বংস হয়ে গেল।
Comments