বৃষ্টির হাতছানি - শিশির আহাম্মেদ খান

 বৃষ্টির হাতছানি !

শিশির আহাম্মেদ খান ।



শ্রাবণের আকাশে যতটা খরা ছিল,  শরৎ এর আকাশ তার ব্যতিক্রম নেই। তার মধ্যে ব্যাপসা গরমে মানুষ অতিষ্ঠ। বর্ষার পরিচিত প্রকৃতি এবার চোখে পড়ে নাই। দ্বিপ্র বাংলাদেশে দাদু বাড়িতে বেড়াতে এসেছে ।
সে জাপানের একটা স্কুলে ক্লাস সেভেন এ পড়ে । মা বাবা জাপানে স্থায়ী বসবাস এর কারণে , তার জম্ম ও বেড়ে উঠা জাপানে।

জীবনে তৃতীয় বার বাংলাদেশ এ আশা হল। কিন্তু বাংলাদেশের আবহাওয়া তার সহ্য হচ্ছিল না । একে ত গরম তার উপর লোডশেডিং। কোথাও গুড়তে ভের  হলে  কোন স্বস্তি নেই ঝানজটের কারণে। দ্বিপ্র অসুস্থ হয়ে পড়ল । বিছানায় শুয়ে আছে , কোন সারা শব্দ নেই।  একে বারে চুপছে গেছে । জ্বরে গা পুরে যাচ্ছে । ওর মা বাবা মাথার কাছে বসে আছে ,চোখ মেলে তাকাতেই পারছে না । ও ছোট বেলা থেকেই খুব ধৈর্য শীল । কষ্ট হলেও কারো কাছে শেয়ার করে না । এই ভাবে তিন দিন হয়ে গেল।  কোন কিছুই খেতে ভালো লাগছে না । বিছানায় শুয়ে জানালার গ্রীলের ফাঁকে আকাশ দেখা।
এই তিন দিন অসুস্থ থেকে মনে হচ্ছে কত বছর ধরে সে বিছানায় পরে আছে । ওর অসুস্থতার কথা শুনে , আপু ,ভাইয়া, খালামনি,  ফুঁফপি , দাদু, নানু , মামা সবাই কত চিন্তার মধ্যে আছে ।

জাপানে পরিবার বলতে মা বাবা । কিন্তু বাংলাদেশে কত মানুষ নিয়ে পরিবার। এ কেমন বন্ধন, যার সুঁতোয় এত গুলো মানুষ কে এক করে রাখে । এত আদর,  এত সোহাগ পৃথিবীর আর কোথাও কি আছে ?
নিজের মনে প্রশ্ন করে দ্বিপ্র , আবার জাপানের কথা চিন্তার করতে লাগল,  কত সুন্দর দেশ! কত পরিপাটি।  কত উন্নত একটা দেশ। 

জাপান কি ভাবে ধ্বংস স্তূপ থেকে ফিনিক্স পাখির মতন আজ বিশ্বের দ্বিতীয় ধনী রাষ্ট্র হল। স্কুলে আমাদের এত বছর যে শিক্ষা দিয়েছে তার মূল কথা বলতে গেলে দুটি বিষয় । প্রথম টি নৈতিকতা বা সৎ , বিনয়ী। দ্বিতীয়ত টি হল কঠোর পরিশ্রম। তাই দেখেছি  জাপানে , সবাই যেমন বিনয়ী , তেমনই সৎ পরিশ্রমী।

বাংলাদেশের মানুষ গুলো এত গরীব কেন  ? মাম্মী কে জিজ্ঞেস করেছি অনেক বার,  তখন মাম্মী বাংলাদেশ নিয়ে অনেক গল্প বলেছে । বলে বাংলাদেশ হল ছবির মতন সুন্দর একটা দেশ । আমার কাছে তেমন মনে হয় না । ঢাকার যা অবস্থা । একটা দেশের রাজধানীর যদি এই অবস্থা থাকে ঝানজটের মেলা , নিয়ম ভাঙ্গার যেখানে উৎসব হয় , যেখানে বড় লোক গুলো কত  সুখে থাকে  আর গরীব মানুষ কতই  না দুঃখে থাকে । কেউ কি নেই গরীবের দুঃখ্য দুর করার  ? মানুষ গুলো খোলা আকাশের নীচে রাস্তার ফুটপাতে ঘুমায়।  ওদের কে সরকার কেন থাকার জন্য ঘর করে দেয়না  ?

জাপানে কখনও এভাবে কোন মানুষ কে রাস্তায় পরে থাকতে দিত কেউ  ? অথচ বাংলাদেশে কত মানুষ রাস্তায় পড়ে থাকে , কত নোংরা পরিবেশ  কিন্তু ওদের দেখার কেউ নেই।  দ্বিপ্র ভেবে অবাক হচ্ছে ওর সমবয়সী বাচ্চারা নোংরা শরির নিয়ে পড়ে থাকে। কিন্তু ওদের বাবা মা ওদের কে বাসায় নিতে আসে না। আমাকে আমার ইস্কুল থেকে আম্মু নিতে না এলে মন খারাপ হয় । অথচ ঢাকাতে কত বাচ্চারা রাস্তায় পড়ে থাকে । ওদের ঘর মনে হয় খোলা আকাশের নিচে  ইট পাথরের ফুটপাত নয়ত ফ্লাইওভার এর নিচে। ওরা কি কখনও ইস্কুলে যায়  ? ওদের কি ইস্কুলে রঙ্গিন ক্লাসরুম আছে। যেখানে বিশ্ব চেনা যায় ?

এই দেশের সাধারণ মানুষ গুলো এত রোগা আর নোংরা কেন থাকে আর ধনী গুলো ঝাড়বাতির রঙ্গিন আলোতে ডুবে থাকে কেন  ? মানুষ কেন মানবিক হয় না। এ ভাবে ও মানুষ থাকতে পারে বাংলাদেশে না এলে বুঝতেই পারতাম না।

রাত তিন টা বাজে এয়ারপোর্ট এর দিকে আমাদের গাড়ি ছুটছে । শরৎ এর রাতের বৃষ্টি ভেজা পথে মানুষ ফুটপাতের মধ্যে পড়ে আছে । এই শহরে এত মশা , ওদের কে কি মশা কামড় দেয় না  ?

মনটা খুব খারাপ লাগছে  আমার,  দাদুর কথা আর নানুর কথা বারবার মনে পরছে। বুকের ভিতরের কেমন যেন ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে । কি আজব দেশে আমার মাম্মী , বাবা বড় হয়েছে। দাদু - নানু থাকে । এই দেশ টা স্বাধীন করতে আমার দাদা যুদ্ধ করে মৃত্যু বরণ করে ছিল  !

সেই যুদ্ধের গল্প কত শুনেছি । কিন্ত বুকের রক্ত দিয়ে দাদা যে দেশের স্বাধীনতা দিয়ে গেল , সেই দেশ কত অবহেলিত  !
বিমানে লম্বা একটা ঘুম  দিলাম।  মাম্মীর ডাকে ঘুম ভাঙ্গল,  কিছুক্ষণ পর ডুবাই এয়ারপোর্ট এ বিমান অবতরণ করবে ।
মাম্মী , বাবার চোখ ফুলে আছে । বুঝতে পারছি ওরা বাংলাদেশ ছেড়ে আশার জন্য পুরো টা সময় কান্না করেছে । অনুন্নত একটা দেশের জন্য কত আবেগ । এটাই কি আসল পরিচয়  ?  সব কিছু ছাড়িয়ে কেন যেন আমার ও খারাপ লাগছে। আমি যদি আমার দাদু, ফুঁফপি,  নানু, মামা সবাই কে জাপানে নিয়ে আসতে পারতাম।  আর কি যেন একটা হারিয়ে ফেলেছি মনের মধ্যে সেই চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।

মনে করতে পারছিলাম না । জাপানে পৌঁছায় এ বস্তু হয়ে গেলাম।  কিন্ত মনের মধ্যে ঘুরপাক এখনও খাচ্ছে বাংলাদেশে কি রেখে আসলাম।  হঠাৎই আকাশে চোখ পড়ল, একটুকরো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। মনে হচ্ছিল মেঘ গুলো হাতছানি দিয়ে ডাকছে আমাকে। বলছে এসো বাংলাদেশে এসো। বুকের মধ্যে একটা ঝড় বয়ে গেল,  চোখের কোণে দু ফোঁটা জল ছলছল করছে। আকাশ থেকে এক পসলা বৃষ্টি শুরু হল। বৃষ্টিস্নানে হাটতে থাকলাম জাপানের ফুটপাত ধরে।
মনে হচ্ছিল পেছন ফিরে তাকালেই দেখব আমি বাংলাদেশ এ ফিরে এলাম......

Comments

Popular posts from this blog

অজেয় তারুণ্য / শিশির আহাম্মেদ খান

রক্ত গঙ্গা / শিশির আহাম্মেদ খান

White - Shishir Ahmed Khan