বুকের মাঝে বিডি- দিলরুবা আহমেদ
বুকের মাঝে বিডি- দিলরুবা আহমেদ
সারা খুব লম্বা মেয়ে। লিকলিকে শুকনো। মাথায় সব সময় কাপড়ের টুপি পরে থাকে। চুল ঢেকে রাখে ধমীর্য় কারণে। সেও মুসলমান। অন্য দেশীয় মুসলমানেরা কেমন হয় জানার সাধ ছিল নিহার অনেক দিনের। এখন সারাকে পেয়ে সে বেশ পর্যবেক্ষণে মত্ত।
একটা সরকারি স্কলারশিপে নিহা বেশ কিছুদিন হয় আমেরিকায় এসেছে। যতোটুকু পারা যায় পড়াশোনার ব্যস্ততার মধ্যেই সে জেনে নিতে চায় অচেনা অজানা এই মহাদেশটিকে।অবাক হয়ে চারদিক দেখে। কতো দেশের কতো রকমের
মানুষের যে বসবাস এখানে! হরেক রকম মানুষ। লাল, শাদা, গোলাপি, বাদামি, কালো। যেন এক খিচুড়ি নিবাস। একেকজনের উৎপত্তিস্থল একেক মহাদেশে। আদি আর অন্তের দূরত্বই যোজন যোজন। বিশ্বের সব কানাকুনা থেকে সংগৃহীত হয়েছে যেন এই সকল মানব স্যাম্পল। তারপরে চানাচুরের বক্সে ভরে এক মহা ঝাকুনি। ঝাকুনির চোটে সোমালিয়ান সারাও এখন আমেরিকান হয়ে গেছে। কোথায় সেই আফ্রিকা মহাদেশ আর কোথায় এই আমেরিকা!
ওয়াশিং রুমে কাপড় ধুতে গিয়ে সারার সঙ্গে নিহার আলাপ। সারার একটা কোয়ার্টার কম পড়েছিল কাপড় ড্রাই করতে। ডলার আছে সঙ্গে। কিন্তু লাগবে কোয়ার্টার। তিনটা কোয়ার্টার অর্থাৎ ২৫ ´ ৩ = ৭৫ সেন্ট লাগে কাপড় শুকাতে। চারটা কোয়ার্টার লাগে ধুতে।
নিহা বদান্যতা দেখালো। একটা কোয়ার্টার দিল সারা—কে। নিহা অবশ্য প্রায়ই শোনে, আমেরিকাতে কেউ কাউকে এক পাই—পয়সাও ধার দেয় না।
সে আরো চব্বিশ পয়সা বেশি দিয়ে নিয়ম ভঙ্গের আনন্দে সারা—র দিকে চাইলো।
সারা তার একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, আমি সারা, আসল নাম জয়নব আড্রেন।
মুসলিম?
ইয়াহ। আর ইউ ফ্রম ইনডিয়া?
নো, বাংলাদেশ।
কোথায় এই দেশ।
নিহা নিজের বুকের দিকে ইশারা করলো, এখানে, বুকের মাঝে।
সারা হো হো করে হেসে উঠলো।
নিহা তার অভিজ্ঞতায় জেনেছে, বুঝেছে, বাংলাদেশকে প্রথমত, কেউ চেনে না। চেনাতে হয় ইন্ডিয়া, পাকিস্তানের লেজ ধরে। দ্বিতীয়ত, চিনলেও চেনে গরিব একটা দেশ হিসেবে।
এখন সে আর চেনায় না। তার বাংলাদেশকে সে বুকের মাঝে রেখে দিয়েছে।
সারা হাত উচিয়ে দূরে একটা অ্যপার্টমেন্ট দেখালো। এক হাজার চব্বিশ নাম্বার দরজাটা আমার, এসো।
চলে যেতে গিয়েও ফিরে চেয়ে বললো, তোমার বুকে করে বাংলাদেশকেও নিয়ে এসো। আমার ঘরে তারও জায়গা হবে। তোমার দেশের গল্প শুনবো।
নিহার এখন আর নিজের দেশের গল্প কাউকে বলতে ইচ্ছে করে না। সবাই ভাব করে যেন কোনো এক দরিদ্র—পীড়িত, দুনীর্তি পরায়ণ দেশ থেকে সে উঠে এসেছে।
একদিন ক্লাসে, অন্য দেশের এক বান্ধবী লাকোনসিয়া বলেছিল, তোমাদের জাতীয় সঙ্গীতটা আমাকে লিখে দাও।
কেন?
আমার হবি। সব দেশের জাতীয় সঙ্গীত কালেক্ট করবো, তারপর বই বের করবো। আইডিয়াটা কেমন?
ভালো, তবে পুরনো। আমার ধারণা এই জাতীয় বইপুস্তক বাজারে প্রচুর আছে।
এ কথায় একটু বিরক্ত হয়েই লাকোনসিয়া বললো, আমাদের দেশে নেই। আমিই প্রথম ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছি।
তার বিজ্ঞ চিত্ত মুখভঙ্গির দিকে চেয়ে নিহা মুখ টিপে হাসলো। লিখতে লিখতে বললো, যে দেশের জাতীয় সঙ্গীত সেই দেশের মানুষের হাতের লেখাসহ জাতীয় সঙ্গীতটা ছাপালে কিছুটা অসাধারণ হবে। ভেবে দেখো।
সে রকমই কিছু ভাবছি। তবে আমার ভাবনাটা পুরোপুরি ফাস করতে চাচ্ছি না। পাছে কমন হয়ে যেতে পারে।
কথাটা শেষ করেই লাকোনসিয়া যে রকম একটা দৃষ্টি ছড়ালো চারদিকে, নিহার তাতে হাসিটাই আকণ্ঠ বিস্তৃত হলো। হাসতে হাসতেই লিখে দিল, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। ট্রান্সলেটও করে দিল।
তাই দেখে লাকোনসিয়া অবাক হয়ে বললো, তোমার দেশ তো গরিব। সোনার বাংলা বলছো কেন? এই গান কে লিখছেন?
রাগে নিহার চোখে পানি এসে গিয়েছিল প্রায়। জবাব দিল, আমরা গরিব না। আমরা খুব ধনী। যিনি এই গান লিখেছেন তিনি একজন নবেল লরিয়েট।
লাকোনসিয়া খুবই অবাক হয়ে তার চোখে পানি আসা আর না পড়তে দেয়ার কারুকাজ দেখলো। এক সময় বললো, সরি, আমি বোধহয় তোমাকে কষ্ট দিয়েছি।
অপমান করেছো।
লাকোনসিয়া হাসতে হাসতে তাকে বুকে টেনে নিয়ে বললো না, কে বলে তোমরা গরিব? তোমাদের যা আছে অমন কি সবার, সব দেশের থাকে! এত ভালবাসা!
সেই থেকে বাংলাদেশ আছে নিহার বুকের মাঝে। পরিচয় করায় না এর। আগলে রেখেছে। সব আঘাতের বাইরে থাকবে তার দেশ।
সারার বাসায় এই দেশ নিয়ে আলোচনায় সে কখনোই যাবে না। সারা জানে না, বুঝবেও না, সকল দেশের রানী সে যে তার জন্মভূমি।
পরের সপ্তাহেই রোজা শুরু হলো।
সারাই কিছু ইফতারি নিয়ে হাজির হলো নিহার অ্যাপার্টমেন্টে। এক রুমের অ্যাপার্টমেন্ট। স্টুডেন্ট লাইফে যেমন হওয়ার কথা তেমনই। রান্না—বান্নার জোগাড়যন্ত্রও সামান্যই তার।
সারার আনা এতো রকমের ইফতারি তাকে মুগ্ধ করলো। সারা এনেছে সমুচা। আশ্চর্য্য সারার দেশেও সমুচার চল আছে। দেখতেও একই রকম, খেতেও একই রকম মজা। সুজির পায়েস রেধেছে ঠিক বাংলাদেশের মায়েদের মতোন করে দুধ দিয়ে। আশ্চর্য দুই দেশের রান্নায় এতো মিল হয়, অথচ দুটো ভিন্ন মহাদেশে দুটো দেশের অবস্থান।
শুধু লুডলস রেধে এনেছে অদ্ভুতভাবে। চাকচাক খাসির মাংস রেধে সিদ্ধ নুডুলসের সঙ্গে সাজিয়ে রাখা। আলুও ভেজে একপাশে দেয়া আছে। তবে খেতে ভালোই লাগছে।
ভিন্ন দেশে স্বদেশি খাদ্যের খোজাখুজি চললো কিছুক্ষণ।
এক সময় সারা বললো, তোমাদের দেশে নাকি ছেলে কিনে নেয় বিয়ের জন্য?
নিহা অবাক হয়ে বললো, কই, সে রকম তো কোনো মার্কেট নেই।
হি হি করে হেসে সারা বললো, আমি শুনেছি ইনডিয়াতে নাকি এ রকম হয়। অনেক টাকা পয়সা দিয়ে মেয়ের বাবারা ছেলেদের কিনে নেন। সোনাও দেয় প্রচুর।
হয়তো ইন্ডিয়াতে হয়, আমাদের দেশে সে রকম কোনো ঘটনা ঘটে না। ছেলেরা খুবই আÍমর্যাদা সম্পন্ন। তারা সে রকম করে না।
সারা খুব অবাক হয়ে বললো, তাই? আমি যে অন্য রকম শুনলাম।
ভুল শুনেছো।
সারা আরো কিছুক্ষণ বসলো। হয়তো আরো কিছুক্ষণ বসার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আড্ডা আর জমলো না। এক সময় সে তার বাসায় চলে গেল।
সে রাতে পচিশ বছরের নিহা আনমনে জীবনে প্রথম অচেনা—অজানা কিছু যুবককে একটা চিঠি লিখতে শুরু করলো অযাচিতভাবেই।
বাংলাদেশের ছেলেরা,
তোমরা কি জেগেছো! এখন তো ওখানে দিনের আলো। রাত আছে আমার কাছে, আমার আকাশে। তারপরও কি তোমরা ঘুমাচ্ছ। তোমাদের যে জেগে উঠতে হবে, আমার একটা প্রশ্ন ছিল তোমাদের কাছে। আচ্ছা, বলো তো, এমন দিন সত্যিই একদিন আসবে না, যখন সবাই বলবে আমি সত্যবাদী। সোনার বাংলাদেশের প্রতিটি ছেলেই সোনায় গড়া। সোনা দিয়ে তাদের মুড়তে হয় না শ্বশুর দেশের লোকদের। সেই দিন কবে হবে? কবে সেই দিনে দাড়িয়ে আছি ভেবে আমি অসীম গর্বে তাকাবো বিশ্বের দিকে।
চিঠি লেখা শেষ করে না নিহা। এ পর্যন্ত লিখেই ছিড়ে ফেলে।
মাটির এ পৃথিবীতে স্বগীর্য় কিছু সে শুধু এখন ভাবে মনে মনেই, কল্পনাতেই।
আজ থেকে ছয় বছর আগে শুধু যৌতুকের জন্যই যে তার বিয়েটা ভেঙে গিয়েছিল এ কথাটা সারাকে সে কোনোদিন জানাবে না, প্রাণ গেলেও না। এ তার দেশের জন্য বড় লজ্জার কথা। এই কলংক কথা থাক শুধু তার জন্য।
Comments